চট্টগ্রামের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের উদ্বোধন হবে আগামী ২৮ অক্টোবর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত প্রায় ৩ দশমিক ৪৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এই টানেলের উদ্বোধন করবেন। উদ্বোধনের পরদিন থেকেই দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম এই টানেলের ভেতর দিয়ে যান চলাচল শুরু হবে। তখন চট্টগ্রাম মহানগরীর পতেঙ্গা প্রান্ত থেকে টানেল পাড়ি দিয়ে আনোয়ারা প্রান্ত হয়ে গাড়ি ছুটবে দুই লেইনের চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে। এই দুই লেনের মহাসড়কের কারণে টানেলের সুবিধা ‘নস্যাৎ’ হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কেননা টানেল চালু হলে এই মহাসড়কে গাড়ির চাপ ক্রমশ বাড়বে। তাই আরও আগেই ১৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কটি চার লেনে উন্নীত করার প্রয়োজন ছিল বলে মনে করছেন তারা।
বঙ্গবন্ধু টানেল পার হয়ে যানবাহনগুলো আনোয়ারার কালাবিবির দীঘি এলাকার পিএবি (পটিয়া-আনোয়ারা-বাঁশখালী) সড়কে উঠবে। সেখান থেকে কর্ণফুলীর শিকলবাহা ওয়াই জংশন পর্যন্ত ছয় লেনের সংযোগ সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। বৃহস্পতিবার (১২ অক্টোবর) সরেজমিনে দেখা গেছে, ইতোমধ্যে চার লেনের নির্মাণকাজ শেষ। বাকি দুই লেনের নির্মাণকাজও চলমান রয়েছে। তবে এখনও কয়েকটি স্থানে নির্মাণকাজ থমকে আছে। টানেল হয়ে এই চার লেনের সংযোগ সড়ক পাড়ি দিয়ে উঠবে ১৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ দুই লেনের চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে। মূলত ১৮ ফুট প্রশস্ত দুই লেনের এই মহাসড়কের কারণেই বঙ্গবন্ধু টানেল ঘিরে যাতায়াতের যে সুবিধা ত্বরান্বিত হওয়ার কথা সেটা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। কেননা টানেল হয়ে হাজার হাজার যানবাহন এই মহাসড়ক দিয়ে যাতায়াত করবে। সড়কটি চার লেন বা ছয় লেনের না হওয়ায় যানবাহনগুলো দ্রুতগতিতে চলাচল করতে পারবে না।
এ প্রসঙ্গে সড়ক পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সহসভাপতি প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, টানেল চালুর আগেই চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কটি চার লেনে উন্নীত করার প্রয়োজন ছিল। কেননা প্রথম দিকে টানেল হয়ে গাড়ির চাপ খুব একটা না থাকলেও পরবর্তী সময়ে ক্রমশ গাড়ির চাপ বাড়বে। এখন চট্টগ্রাম মহানগরীর পতেঙ্গা প্রান্ত দিয়ে টানেল পার হয়ে আনোয়ারা প্রান্তে উঠবে গাড়ি। কিন্তু এরপর গাড়িগুলো কীভাবে গন্তব্যে পৌঁছাবে, সে বিষয়ে তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এখন টানেল হয়ে চার লেনের সংযোগ সড়ক পাড়ি দিয়ে দুই লেনের মহাসড়কে উঠবে। এতে গাড়ির যেই গতি সেটা নিঃসন্দেহে কমাতে হবে। কেননা ছোট মহাসড়ক দিয়ে তো গাড়ি তত বেশি বেগে চালানো যাবে না। মূলত যান চলাচলের সুবিধার্থে বর্তমানে বিদ্যমান চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কটি সামর্থ্যানুযায়ী প্রশস্ত করতে হবে। যাতে অন্তত টানেল উদ্বোধন হওয়ার পর যান চলাচল স্বাভাবিক থাকে।
প্রকল্পের নথি পর্যালোচনা ও প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গছে, সরকার বন্দরনগরী চট্টগ্রামকে চীনের সাংহাই নগরীর মতো ‘ওয়ান সিটি, টু টাউন’ হিসেবে গড়ে তুলতে দক্ষিণ চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলাকে সংযুক্ত করার জন্য কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। টানেলটি প্রস্তাবিত এশিয়ান হাইওয়েকে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের সঙ্গে সংযুক্ত করবে। পাশাপাশি টানেলটি চালু হলে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম শহরকে বাইপাস করে সরাসরি কক্সবাজারের সঙ্গে যোগাযোগও সহজ করে তুলবে। এতে ঢাকা থেকে কক্সবাজার কিংবা চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার যাওয়ার ক্ষেত্রে ৪০ কিলোমিটার দূরত্ব কমে আসবে। এতে সময় ও খরচ দুটোই সাশ্রয় হবে। কমবে চট্টগ্রাম মহানগরীর যানজটও।
এদিকে টানেল নির্মাণ প্রকল্প শুরুর আগে ২০১৩ সালে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের এক সমীক্ষার তথ্যানুযায়ী, ২০২৫ সাল নাগাদ প্রতিদিন টানেল ব্যবহার করবে ২৮ হাজার ৩০৫টি গাড়ি। এর মধ্যে অর্ধেক থাকবে পণ্যবাহী। ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতিদিন গড়ে ৩৭ হাজার ৯৪৬টি এবং ২০৬৭ সাল নাগাদ ১ লাখ ৬২ হাজার যানবাহন চলাচলের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে কক্সবাজার ও বান্দরবানগামী যানবাহনগুলো আউটার রিং রোড হয়ে সরাসরি পতেঙ্গা প্রান্ত দিয়ে টানেলে প্রবেশ করবে। চট্টগ্রাম শহর থেকেও টানেলমুখী গাড়িগুলো একই রুটে যাবে। এরপর আনোয়ারা প্রান্ত দিয়ে বের হয়ে কালাবিবির দীঘি এলাকায় সংযোগ সড়কে নেমে পিএবি (পটিয়া-আনোয়ারা-বাঁশখালী) সড়ক হয়ে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রোড ধরবে।
এ প্রসঙ্গে সওজের চট্টগ্রাম দক্ষিণ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সুমন সিংহ প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, বঙ্গবন্ধু টানেল চালু হলে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে গাড়ির চাপ ক্রমশ বাড়বে। এই চাপ সামাল দিতে প্রাথমিকভাবে মহাসড়কের শিকলবাহা ওয়াই জংশন থেকে সাতকানিয়ার কেরানিহাট পর্যন্ত প্রায় ৩০ কিলোমিটার সড়ক ১৮ ফুট থেকে ৩৪ ফুটে প্রশস্তকরণের কাজ চলছে। প্রায় ১৭৫ কোটি টাকা ব্যয়ে তিন ভাগে এই প্রশস্তকরণকাজ করা হচ্ছে। এরই মধ্যে শিকলবাহা থেকে কমলমুন্সিরহাট পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার অংশের কাজ শেষ। কমলমুন্সিরহাট থেকে সাতকানিয়ার মৌলভীর দোকান অংশের প্রশস্তকরণকাজ চলছে। মৌলভীর দোকান থেকে কেরানিহাট অংশে প্রশস্তরকরণ কাজের জন্য শিগগিরই দরপত্র আহ্বান করা হবে। পুরো কাজ ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে শেষ হবে।
এদিকে আগামী ২৮ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চট্টগ্রামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের উদ্বোধনের প্রস্তুতি নিচ্ছে প্রশাসন। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু টানেলের প্রকল্প পরিচালক মো. হারুনুর রশীদ চৌধুরী প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘নদীর তলদেশে দক্ষিণ এশিয়ার সর্ব প্রথম বঙ্গবন্ধু টানেলের উদ্বোধনের অপেক্ষায় রয়েছি আমরা। ইতোমধ্যে টানেলের মূল কাজ শেষ। এখন টানেলের ভেতরে সাজসজ্জার কাজ চলছে। পাশাপাশি সিভিল, মেকানিক্যাল, ইলেকট্রনিক কাজের ফিনিশিং চলছে। ইতোমধ্যে টানেলের ভেতরে একাধিকবার ট্রায়াল রান করা হয়েছে।’ তিনি জানান, সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০২৫ সালে টানেলে গড়ে প্রতিদিন ২৮ হাজার ৩০৫টি যানবাহন চলাচল করবে।
প্রকল্পের তথ্যানুযায়ী, বঙ্গবন্ধু টানেলটি চট্টগ্রাম মহানগরীর পতেঙ্গার নেভাল একাডেমি প্রান্ত থেকে শুরু হয়ে চট্টগ্রাম ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড (সিইউএফএল) এবং আনোয়ারায় কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার লিমিটেড কারখানার মধ্যে নদীর তলদেশে সংযোগ স্থাপন করছে। ৩ দশমিক ৪৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের বঙ্গবন্ধু টানেলে টিউবের দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার এবং ভেতরের ব্যাস ১০ দশমিক ৮০ মিটার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রেসিডেন্ট সি জিনপিং যৌথভাবে ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু টানেলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন. সুত্র: প্রবা
পাঠকের মতামত